আমাদের শরীরের অন্যতম পরিশ্রমী অঙ্গ হলো কিডনি। প্রতিদিন প্রায় ১৫০ লিটার রক্ত ছেঁকে তা থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়, শরীরের ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু কিডনি সাধারণত নীরব থাকে, যতক্ষণ না এর কার্যক্ষমতায় সমস্যা দেখা দেয়।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পানিশূন্যতা, অতিরিক্ত লবণ খাওয়া এবং অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ ধীরে ধীরে এই সংবেদনশীল অঙ্গগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি বিকল হওয়ার বড় কোনো উপসর্গ দেখা না দিলেও শরীর কয়েকটি সতর্কবার্তা দেয়, যেগুলো উপেক্ষা করা বিপজ্জনক হতে পারে। নিচের যেকোনো লক্ষণ স্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
ক্রমাগত ক্লান্তি ও শক্তিহীনতা
কিডনি ঠিকমতো কাজ না করলে রক্তে বর্জ্য ও বিষাক্ত পদার্থ জমা হতে থাকে। ফলে পরিষ্কার রক্ত শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঠিকভাবে পৌঁছায় না এবং অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত হয়। এর ফলে সারাক্ষণ ক্লান্তি, অবসাদ ও উদ্যমহীনতা দেখা দেয়। পুরো রাত ঘুমানোর পরও শরীর ভারী ও নিস্তেজ লাগে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে (CKD) আক্রান্ত ব্যক্তিদের সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গগুলোর একটি হলো অবসাদ, যা রোগের দ্বিতীয় ধাপ থেকেই দেখা দিতে পারে। এটির পেছনে অ্যানিমিয়া, অক্সিজেনের ঘাটতি, বিপাকীয় অম্লতা, হতাশা এবং ঘুমের ব্যাধির মতো নানা কারণ কাজ করে।
গোড়ালি, পায়ের পাতায় বা চোখের নিচে ফোলা
শরীরে তরলের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে কিডনি। কিন্তু কিডনি দুর্বল হয়ে পড়লে অতিরিক্ত সোডিয়াম ও পানি টিস্যুতে জমে ফোলা বা ফুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। বিশেষ করে চোখের নিচে বা পায়ের পাতায় সকালে শুরু হয়ে দিনজুড়ে স্থায়ী ফোলাভাব কিডনি বিকল হওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে। ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে (CKD) আক্রান্ত অনেকের মধ্যেই এ ধরনের ‘নেফ্রো ফোলাভাব’ দেখা যায়।
প্রস্রাবের স্বাভাবিকতায় পরিবর্তন
প্রস্রাবের রঙ, পরিমাণ বা ঘনত্বে পরিবর্তন কিডনি সমস্যার অন্যতম প্রাথমিক সংকেত। প্রস্রাব ফেনাযুক্ত বা ফেনা জমার মতো হলে বুঝতে হবে এতে প্রোটিন লিক হচ্ছে। গাঢ় বা কম পরিমাণে প্রস্রাব হওয়া পানিশূন্যতা বা বর্জ্য জমার লক্ষণ। রাতে অতিরিক্ত প্রস্রাব হওয়া কিংবা প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া—এগুলোও কিডনির ক্ষতির প্রাথমিক ইঙ্গিত।
উচ্চ রক্তচাপ
রক্তচাপ ও কিডনি কার্যকারিতা একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। কিডনি দুর্বল হয়ে পড়লে পানি ও লবণের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যা উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে। আবার দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ কিডনির রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করে—ফলে তৈরি হয় এক ভয়ংকর চক্র। ওষুধ বা জীবনযাপনের পরিবর্তন সত্ত্বেও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না এলে বুঝতে হবে কিডনি ইতিমধ্যেই চাপে রয়েছে।
পেশি খিঁচুনি ও খনিজের ভারসাম্যহীনতা
কিডনি শরীরের ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও সোডিয়ামের মতো খনিজগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করে। কিডনি দুর্বল হলে এসব খনিজের ঘাটতি বা ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, যার ফলে পেশিতে টান, দুর্বলতা বা হঠাৎ খিঁচুনি হতে পারে। অনেক সময় রাতে বা বিশ্রামের সময়ই এ ধরনের খিঁচুনি শুরু হয়। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্তদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী মাংসপেশীর ব্যথা (Chronic Musculoskeletal Pain) খুবই সাধারণ একটি সমস্যা, যা প্রায়ই ইউরেমিয়া বা রক্তে বর্জ্য জমার সঙ্গে সম্পর্কিত।
কিডনি সমস্যা নীরবে শুরু হয়, কিন্তু এর ফল হতে পারে প্রাণঘাতী। তাই শরীরের ক্ষীণতম সতর্ক সংকেতগুলোকে অবহেলা করা উচিত নয়। সময়মতো পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিলে কিডনি সুস্থ রাখা সম্ভব। নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান, কম লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং রক্তচাপ ঠিক রাখা—এই অভ্যাসগুলোই কিডনিকে দীর্ঘদিন সক্রিয় ও সুরক্ষিত রাখতে পারে।
